জাগো দশপ্রহরণধারিনী
ডাঃ শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
প্রতিবছর সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস।বর্তমানে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা বা কন্যাসন্তানের ভ্রূণহত্যার সমীক্ষা মনে রাখলে এই নারীদিবস যাপন শুধুই কোনও উৎসবপালন নয়।কিন্তু যদি শুধুই মানসিক স্বাস্থ্যর নিরিখে বিচার করা হয়,তাহলেও মেয়েদের মানসিক সুস্থতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে দেখবার একটি বিষয় হয়ে উঠবে।
হরমোনজনিত কারণেই হোক বা সামাজিক অবস্থান, নারীর জীবন পুরুষদের থেকে হাজার গুণ জটিল।এই জটিলতা নানান দিক দিয়ে দেখা যায়। সামাজিক দৃকক্ষেপে যদি দেখি তাহলে একটি মেয়ের জটিলতাহীন জীবনে প্রথম অস্বস্তিকর ঘটনা বয়োঃসন্ধি।তার ঋতুমতি হয়ে ওঠা তাকে অন্য লিঙ্গের থেকে আলাদা করে।যদিও এবিষয়ে এখন সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক বেশি সচেতন।এর পর তার কাছে চ্যালেঞ্জ হলো তার নারীত্ব বহন করা।প্রাউলিং,স্টকিং,ভারবাল মোলেস্টেশন ,এই ধরনের শব্দবন্ধ পাশ্চাত্য পার করে আজকাল ভারতীয় সংস্কৃতিতেও ঢুকে পড়েছে।মনে রাখতে হবে,মনের স্থিরতা ভেঙে ফেলতে ধর্ষণের মতোই ভয়ঙ্কর এই ছোট ছোট ঘটনা।বিবাহ পুরুষ ও নারী জীবনের একটি বিচিত্র ও জটিল ঘটনা।তার পরবর্তী যে পরিবর্তন প্রয়োজন,তা নারীর ক্ষেত্রে কিছুদিন আগেও অনেক বেশি কঠিন ছিল।এখন অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের গঠন অণু পরমাণুতে ভেঙে পড়ায় সে কাঠিন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে আংশিক কমেছে।কিন্তু নির্মূল হয়েছে কী?আরেকটি বড় মোড় হলো সন্তানবতী হবার স্তর। এই সময় শরীর জুড়ে ঘটতে থাকা নানান জৈবিক পরিবর্তন একটি মেয়ের জীবনে অবসাদ বা মানসিক ভারসাম্যহীনতা এনে দিতেই পারে।ঘটে যেতে পারে প্রসবপরবর্তী অবসাদ বা ‘পোস্ট পার্টাম ব্লু’।আবার ঋতুবন্ধ এক নারীর জীবনে অন্যরকম একটি পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সে সময়ের জটিল পরিস্থিতিতে সম্পর্কহানি বা আত্মহত্যাচিন্তা মাথায় আসাও অসম্ভব নয়।
নারীকে পুরুষের থেকে মনোজগতের নিরিখে যে পার্থক্য গড়ে দেয় তা হলো ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরোনের ভারসাম্যহীনতা।এই দুই হরমোনের সঙ্গে বাড়তি মাত্রা যোগ করে আরও একটি হরমোন।তার নাম অক্সিটোসিন।শেষ হরমোনটি মানুষের মনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা বাড়ায়।এই হরমোন নিঃসৃত হয় অনুভূতিঘন স্পর্শ থেকে।
মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখতে হবে দেখে নিই।
১।অবসাদ অবহেলা করবেন না।মানসিক অবসাদ খুব মৃদু মাত্রায় হলে যেসব কাজ করলে মন ভালো থাকে সেখানে মনোনিবেশ করুন।গাছ লাগান,গান শুনুন,রান্নাবান্না,সিনেমা দেখা।চলতেই পারে।কিন্তু যেই মুহূর্তে সেই অবসাদ দৈনন্দিন জীবনযাপনকে ব্যাহত করবে সেই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে দেরী করবেন না।
২।জীবনযাত্রা পালটে ফেলুন।দৈনিক রুটিনে যোগ করুন জিম।অথবা যোগব্যায়াম। খানিকটা সময় দিন ধ্যানের জন্য।দৈনিক খাবারে চর্বির পরিমাণ কমিয়ে বাড়িয়ে দিন ফলের পরিমাণ।রোদ্দুর লাগাতে হবে গায়ে।নিয়ম করে।এতে শরীরে ভিটামিন ডি বেশি মাত্রায় যুক্ত হবে।ভিটামিন ডি শরীরে যথাযথ মাত্রায় থাকলে গবেষণা বলছে মনের অবসাদ কমে যায়।
৩।বিবাহিত জীবনে নিয়মিত শারীরিক সান্নিধ্য অত্যন্ত জরুরি। একটি সুস্থ দাম্পত্য শারীরিক দূরত্বে বেশিদিন টিকে থাকা অসম্ভব।
৪।জীবনের বিশেষ বিশেষ কিছু সময় প্রতিটি নারীর পাশে থাকতে হবে তার পরিবারকে।যেমন বয়োঃসন্ধি, প্রসব বা ঋতুবন্ধকালীন।সোশ্যাল সাপোর্ট অটুট ও মজবুত থাকলে অনেক মনোরোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব।
৫।শারীরিক নির্যাতন বা হেনস্থা পুরুষ হোক বা নারী,উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান ক্ষতিকারক।অপরাধকে প্রশ্রয় দেবেন না।প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, পুলিশ আধিকারিক বা আইনজ্ঞর পরামর্শ নিতেই হবে।
নারী মানেই দশভূজা।তাকে ছাড়া জগত সংসার অচল।তাই তাঁকে ভিতর থেকে মজবুত করতে আসুন,শুধু একটিই দিন নয়,প্রতিটি দিনই হয়ে উঠুক বিশ্ব নারী দিবস।
লেখক শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী একজন প্রতিষ্ঠিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং বর্তমান সময়ের উল্ল্যখযোগ্য কবি ও সাহিত্যিক।